কওমি মাদরাসা ঐশী চেতনা ও বিশ্বাসের বাতিঘর। হেরা গুহায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওপর নাজিলকৃত যে নুর আসহাবে সুফ্ফার মাঝে বণ্টন হয়েছিল, বক্ষমান কওমি মাদরাসা হচ্ছে সে নুর অর্থাৎ ইলমের ধারক-বাহক। কওমি মাদরাসায় রাত-দিন তাওহিদ ও রিসালাতের সুমহান বাণী উচ্চারিত হয়। এ মাদরাসাগুলোতে এক এক করে হাতে-কলমে চারিত্রিক নৈতিকতার অর্জনীয় ও বর্জনীয় সিফাতগুলোর বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কওমি মাদরাসা আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের এক অদৃশ্য শক্তি যা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারত উপমহাদেশের সব কওমি মাদরাসাগুলোতে কোরআনে বর্ণিত চারটি মূলনীতির ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়। এক . বিশুদ্ধভাবে কোরআন পাঠ। দুই . আত্মশুদ্ধি অর্জন। তিন . কোরআনের সহিহ ব্যাখ্যা প্রদান। চার . হিকমত তথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সালামের সুন্নতের বাস্তব অনুশীলন। এই মূলনীতিগুলোকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সে বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। এই চারটি মূলনীতির ওপর শিক্ষা গ্রহণের ফলে প্রত্যেকেই একজন আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে সমাজের বুকে ফিরে যায়। তাদের আদর্শিক নেতৃত্বদানের ফলে সমাজে তৈরি হয় যোগ্য উত্তরসূরী। তাদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ধর্মীয় বলয়ে ও কৃষ্টি-কালচারে গঠিত হয় আদর্শ সমাজ ও সুশৃংখল সমাজব্যবস্থা।
কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আজ দেড়শ বছরের ইতিহাসে, এসব মাদরাসায় পড়তে এসে কারো সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে অথবা প্রতিহিংসার বলি হয়ে কাউকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় নি। খালি হয়নি কোনো মায়ের বুক। এসব মাদরাসায় কখনো বেজে ওঠে নি অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেখা যায়নি কখনো অস্ত্রের মহড়া দিতে। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, শেয়ার কেলেঙ্কারি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ সব ধরনের চারিত্রিক কলঙ্ক থেকে মুক্ত এসব মাদরাসা এবং তার সন্তানেরা। তাইতো এসব মাদরাসা সমাজের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা আদর্শ সমাজ, উন্নয়নশীল দেশ ও আদর্শ জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বাস্তবেও তাই প্রতিফলিত হয়েছে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তস্নাত আজাদি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ১৯৪৭ সালে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। শাহ অলিউল্লাহর হাতে সূচিত হয় ঐতিহাসিক আজাদি আন্দোলন। কিছুদিন পর দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতী সন্তান শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান ও হুসাইন আহমদ মাদানী প্রমুখের হাতেই স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভ করে। আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় মুসলমানদের রক্তঝরা আন্দোলনের ফসল পাকিস্তানের সেতু বয়ে-ই আজকের স্বাধীন সর্বভৌম দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ আজ স্বমহিমায় বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত যে, কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামের মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তার সংরক্ষণের মাধ্যমে দীনি-দাওয়াত ও তালিম তারবিয়াতের এক বিশ্বজনীন ইসলামী মিশন। ইতিহাস সাক্ষী গোটা ভারতবর্ষে যখন ব্রিটিশ কর্তৃক বর্বর নির্যাতনের শিকার, ওদের নির্যাতনের কারণে ভারত উপমহাদেশের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল এবং দিশেহারা গোটা জাতি যখন স্তব্ধ, তখন ওই ব্রিটিশ তাড়ানো অদম্য বাসনা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন কওমি মাদরাসার সূর্যসন্তানেরা।
ভারত উপমহাদেশের এসব কওমি মাদরাসা সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। এসব মাদরাসা থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ছড়িয়ে পড়ছে ঐশী নুরের পবিত্র ঝরনাধারা। এই পবিত্র ঝরনাধারা থেকে প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছে সমাজের সব পেশার মানুষ। সমাজের সব পেশার মানুষ নানা সমস্যার সমাধান পাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে। একজন ব্যক্তির জন্মের পূর্ব থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত, এই ঝরনাধারা থেকে উপকৃত হতে হয় এবং হচ্ছেও। গর্ভকালীন সময়ে নানা সমস্যার সমাধান, জন্মের পর পরবর্তী করণীয়, আকিকা, বিবাহ শাদীসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কওমি মাদরাসার সন্তানদের প্রয়োজন পড়ে। জানাজা, কাফন- দাফন, ইসালে সওয়াব, এবং সহিহ আকিদা, সব ধরনের ইবাদত, মুয়ামালাত, মুয়াশারাতসহ ব্যক্তি জীবনের নানা সমস্যার শরয়ী সমাধানের জন্য মানুষ এসব মাদরাসার দ্বারস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যা অনস্বীকার্য। কওমি সন্তানদের সান্নিধ্য ও দীনের সঠিকপথে পরিচালিত হওয়ার মাধ্যমে হাজারো মানুষের মধ্যে এসে যাচ্ছে অকল্পনীয় পরিবর্তন।
কওমি মাদরাসা সমাজের জন্য আলো, সাম্য ও সৌন্দর্যের পতাকাবাহী। এসব মাদরাসা জঙ্গী প্রজনন কেন্দ্র নয়, বরং আদর্শ মানুষ ও আদর্শ জাতি উপহার দেওয়ার কারখানা। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি রয়েছে কওমি মাদরাসার বিপুল ও অসীম অবদান। আল্লামা ড. ইকবাল (রহ.) বলেন, এ মক্তব-মাদরাসাগুলোকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। গরিব মুসলমানদের ছেলেরা এগুলোতে পড়ছে, পড়তে দাও। এ মোল্লা ও ফকিরগুলো যদি না থাকে তবে কি হবে? যা হবে তা আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি। ভারতবর্ষের মুসলিমরা যদি এ মুক্ত মাদরাসাগুলোর প্রভাব থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে, ফলাফল ঠিক তাই হবে যা ছিল গ্রানাডা ও কর্ডোভায়। সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলিম শাসন সত্ত্বেও আজ সেখানে ধ্বংসাবশেষ এবং আলহামরা ও বাবুল খাওয়াতিনের নিদর্শন ছাড়া ইসলামের অনুসারীদের ও ইসলামী সভ্যতার অন্য কোনো নিদর্শন অবশিষ্ট নেই। অনুরোধে মক্তব-মাদরাসাগুলো না থাকলে ভারতবর্ষেও আগ্রার তাজমহল এবং দিল্লির লালকেল্লা ছাড়া ৮০০ বছরের মুসলিম শাসন ও মুসলিম সভ্যতার কোনো নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে না। (মাসিক নেয়ামত, ঢাকা, আগস্ট-১৯৯০)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যেই মন্তব্য করেন তা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, মাদরাসা শিক্ষার একটা গৌরবজনক অধ্যায় রয়েছে। উপমহাদেশে যখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তখন মক্তব-মাদরাসা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে কমিশনের পর আমরা জানতে পেরেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এসব শব্দগুলো। মাদ্রাসায় লেখাপড়ার মান উন্নত ছিল। কোরআন হাদিসের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক পড়ানো হতো। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়েছেন এ উপমহাদেশের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি। তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে, সমাজ সেবার ক্ষেত্রে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অথবা কবি সাহিত্যিক হিসেবে স্বনামধন্য। তাদের নাম বলে শেষ করা যাবেনা। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কওমি মাদরাসার প্রচলন হয়। এ মাদরাসার ছাত্রদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে গড়ে তোলার ঐতিহ্য রয়েছে। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম অথবা বিভিন্ন পর্যায়ে জনস্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে কওমি মাদ্রাসার বড় ভূমিকা ছিল। দেশের একটি বিশাল শিক্ষার্থীর অংশ এখনো কওমি মাদরাসা হতে আলো পায়। এই কওমি মাদরাসা সম্পর্কে কোনো কথা বলা হবে না। তারপরও এটি জাতীয় শিক্ষানীতি হবে তা হতে পারে না। (মাসিক আত-তাওহীদ ২০১০)